দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এমন সময়ে, যখন স্বাধীনতার বুকে গড়ে ওঠা প্রথম সরকারের পোর্টফোলিও ধারণকারী তাজউদ্দীন আহমদের নামে স্বীকৃত মুক্তিযোদ্ধাগণের তালিকা প্রকাশ থেকে তুলে নেওয়া হলো, তখন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম সরাসরি প্রশ্ন তুললেন: “তাজউদ্দীন আহমদ মাঠে থেকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন—তবে কেন তার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল হলো?

Source: Ittefaq | 4 June 2025 | Pic: Collected
সারজিসের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে বুধবার (৪ জুন) সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে পোস্ট করা বক্তব্যে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিনগুলোতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বন্দি হিসেবে ছিলেন, তবে যুদ্ধের সময় তিনি বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতার শপথ-বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও সরাসরি মাঠে ছিলেন না। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ সরাসরি সংগ্রামের কেন্দ্রে থেকে লড়াই করেছে—তাঁর স্বীকৃতি কেন বাতিল?” সারজিসের এই লিখিত প্রশ্ন ঘিরে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
তাঁর পোস্টে আরও দাবি করা হয়েছে, “যারা স্বাধীনতার পথে আসল মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা ভোগ করছে, কেউ কেউ সদ্য মাত্র আওয়ামী মন্ত্রিত্বের আমলেই ‘নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা সেজে’ সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের কাজ হওয়া উচিত এ ধরনের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে তাদের সনদ বাতিল করা—কিন্তু তারা কেন এমন অনন্যায় করছে যে, স্বাধীনতার অগ্রদূত ও দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হলো?”
সারজিস আসলে ইতিহাসের পাথেয় তুলে ধরে এক গভীর প্রশ্ন ছুঁড়েছেন—দেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু গুলি-গোলায় সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং স্বাধীনতার আদর্শ ও নেতৃত্বের সুরক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে শেখ মুজিবুর রহমান যখন বন্দি ছিলেন, তখন তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে মাত্রই স্টাফ-এন্ড-স্ট্র্যাটেজি মিশন লিড করেছেন। তাঁর অধ্যবসায়, কূটনীতি ও নেতৃত্ব যথাযথভাবে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য ছিল—সেটাই সারজিসীয় যুক্তি।
শুধু সারজিসই নয়, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগঠনগুলোও প্রশ্ন তুলছে: “সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্র না কাটালেও তাজউদ্দীন আহমদের অবদান ইতিহাসের মেঝে চুম্বন করে—তাঁর মতো প্রথম সারির নেতাদের মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ দেওয়া গেলে কি আমরা সে বছরগুলোর সংগ্রাম পূর্ণমাত্রায় স্বীকৃতি দিচ্ছি?” বিশেষ করে, “মুক্তিযুদ্ধের সময় মন্ত্রণালয় কি শুধু খোঁজে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের, নাকি তাই তাদের উচিত যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে খাঁটি মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা নিশ্চিত করা?”—এসব ইস্যু এখন নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
এ প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ড. আজিজুল ইসলাম বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা হাত হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে যুদ্ধের প্রবেশদ্বার সৃষ্টি করেছে, তার থেকে বড় অবদান হল সংগ্রামের রাজনৈতিক নেতৃত্বদান। তাজউদ্দীন আহমদকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা না করা স্বাধীনতা দিবসের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।” ড. আজিজুল আরও যুক্ত করেন, “স্বাধীনতার বীজ বপনের সময় যাদের ভূমিকা ছিল, তাদের মর্যাদা রক্ষা করা হবে—ইতিহাস এমনই পাঠ দেয়।”
এদিকে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া এখনও পাওয়া যায়নি। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, “একবার বাতিল হওয়া স্বীকৃতি পুনর্বিবেচনার সুযোগ থাকলে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত আবার ফিরিয়ে আনা যায় এবং সঠিক তথ্য-যাচাইয়ের মাধ্যমে জনগণের আস্থা জোরদার হয়।” একজন বিশ্লেষক নাম প্রকাশ না করে জানালেন, “রাজনীতিতে যেহেতু ক্ষমতার ওঠাপড়া থাকে, তাই মুক্তিযুদ্ধের মতো সংবেদনশীল ইস্যু শুরুতেই এগিয়ে নিতে হবে সঠিক বিচার-বিবেচনা নিয়ে।”
তাজউদ্দীন আহমদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল যেমন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত, তেমনি সেটি নতুন করে জাতীয় ঐক্য ও ইতিহাসের প্রতি আমাদের দায়িত্বের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। সারজিস আলমের প্রশ্ন “কী করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ পড়লেন সেই নেতা, যিনি মাঠে না থাকলেও সংগ্রামের গোড়া থেকে ফ্রন্টলাইন স্থাপন করেছিলেন?”—এ প্রশ্নের যথাসময়ে সুষ্ঠু উত্তর খুঁজে বের করতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিধারা শক্ত থাকবে। আর না-খুঁজে পেলে হয়তো কালো ইতিহাসের মতো দাগ লেগে থাকবে আমাদের সংগ্রামী গৌরবের পৃষ্ঠায়।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও আদর্শের প্রতিফলন—এতে তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতাদের অবদান অপরিহার্য। তাই এখন প্রয়োজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শুদ্ধকরণের পাশাপাশি খাঁটি মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা নিশ্চিতকরণ। নয়তো ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে—বরিশালের সেই ছোট্ট মেঠোপথ থেকে শুরু করে জাতির মুক্তির সিংহভাগ যাত্রা নতুন করে পরিমাপের মুখে ঠেলা হবে।