ইসরায়েল ও ব্রাজিলের কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন করে বড় ধরনের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে, যখন ব্রাজিল সরকার ইসরায়েলের মনোনীত নতুন রাষ্ট্রদূতের অনুমোদন না দেওয়ায় তেল আবিব আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের নিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের স্তর নিম্নমুখী করার ঘোষণা দিয়েছে।

27 August 2025 | Pic: Collected
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকার ব্রাজিলে নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে গালি দাগানকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, যিনি পূর্বে জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার নেতৃত্বাধীন ব্রাজিল সরকার দীর্ঘ সময় ধরে তার নিয়োগপত্র অনুমোদন না দিয়ে নীরব অবস্থান নেয়, যা ইসরায়েলের কাছে অস্বাভাবিক এবং অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। অবশেষে ইসরায়েল এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিয়ে জানায়, ব্রাজিলের এই আচরণ তাদের প্রতি স্পষ্ট অবমাননার শামিল এবং এর ফলে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক “গুরুতরভাবে হ্রাসপ্রাপ্ত” হবে। মূলত গাজা যুদ্ধ নিয়ে লুলার প্রকাশ্য সমালোচনাই এই কূটনৈতিক টানাপোড়েনকে আরও জটিল করেছে।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা বারবার ফিলিস্তিনি জনগণের মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং ইসরায়েলের সামরিক অভিযানকে “গণহত্যা” বা “হলোকাস্টের মতো হত্যাযজ্ঞ” বলে অভিহিত করেছেন। তার এই কঠোর মন্তব্যে ইসরায়েল ক্ষুব্ধ হয় এবং গত ফেব্রুয়ারিতে লুলাকে “ইসরায়েলে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি” ঘোষণা করে। এ ছাড়া, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ব্রাজিলে নিযুক্ত তাদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নেয় এবং দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক ও কূটনৈতিক সংলাপ কার্যত স্থগিত হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক রাষ্ট্রদূতের অনুমোদন না দেওয়ার ঘটনায় ইসরায়েল বলছে, তারা এখন ব্রাজিলের সাথে সম্পর্ক শুধুমাত্র “প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা” পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখবে, অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রদূতের পরিবর্তে চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স বা নিম্নস্তরের প্রতিনিধি দিয়ে সম্পর্ক পরিচালনা করা হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্রাজিলের এই অবস্থান তাদের আন্তর্জাতিক নীতির অংশ, যেখানে তারা ফিলিস্তিনের স্বাধিকারকে সমর্থন করে এবং একাধিকবার জাতিসংঘে ফিলিস্তিনপন্থী প্রস্তাবে ভোট দিয়েছে। অপরদিকে ইসরায়েল মনে করছে, ব্রাজিল তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষার অধিকারের প্রতি অবমাননা করছে।
এই কূটনৈতিক সংকট শুধু ইসরায়েল ও ব্রাজিলের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেই নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে লাতিন আমেরিকার ভূমিকার দিকেও আলোকপাত করছে। ব্রাজিল বর্তমানে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য দেশ হিসেবে কাজ করছে এবং গাজা যুদ্ধবিরতি বিষয়ে তারা বারবার যুদ্ধবিরতির পক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখেছে, যা ইসরায়েলের জন্য কূটনৈতিকভাবে অস্বস্তিকর। ফলে দুই দেশের সম্পর্কের এই অবনতির মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন গাজা ইস্যুতে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর অবস্থান স্পষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে ইসরায়েলও বুঝিয়ে দিচ্ছে যে তারা যেকোনো রাষ্ট্রের কূটনৈতিক অবস্থানকে তাদের জাতীয় স্বার্থের আলোকে মূল্যায়ন করবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ঘটনায় লাতিন আমেরিকার আরও কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক চাপ বাড়াতে পারে, বিশেষত চিলি, কলম্বিয়া ও বলিভিয়ার মতো দেশগুলো ইতিমধ্যেই গাজা যুদ্ধ নিয়ে তেল আবিবকে কঠোরভাবে সমালোচনা করছে।
এদিকে ইসরায়েলি গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, গালি দাগানকে ব্রাজিলে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগের পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় ইসরায়েলের কূটনৈতিক কৌশলে বড় ধাক্কা এসেছে, কারণ ব্রাজিল লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী দেশ। লুলা সরকারের এই সিদ্ধান্তে ইসরায়েল-ব্রাজিল বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতাও প্রভাবিত হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে দুই দেশ সম্পর্ক ছিন্ন করেনি, তবে সম্পর্কের স্তর নেমে আসায় ভবিষ্যতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।